দূরে তাকালেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে সবুজে ঘেরা পাহাড়ে মেঘের আলিঙ্গন। পাহাড়ের বুকে রয়েছে অসংখ্য ঝর্ণা। আর ওই পাহাড়ের তলদেশ বা নিচ থেকেই শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত। যেখানে তাকালেই কেবল সাদা সাদা পাথর, মাঝখানে স্বচ্ছ নীল পানি, উপরে নীল আকাশ। সব মিলিয়ে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ( Bholaganj Sada Pathor ) যেন প্রকৃতির এক অপরুপ লীলাভূমি। ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর কোথায় অবস্থিত বাংলাদেশের সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ গ্রামেই Bholaganj Sada Pathor অবস্থিত। ভোলাগঞ্জের দূরত্ব সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। ভোলাগঞ্জের অপর পাশে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। মেঘালয়ের উঁচু উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসে ঝর্ণা ধারার পানি, যা ধলাই নদের প্রধান উৎস। এই পানির ঢলের সাথে চলে আসা পাথর ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্টের বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর নামকরণঃ
ভোলাগঞ্জ বর্ডারের ১০ নং ঘাট থেকে ধলাই নদ ধরে কিছু পথ ইঞ্জিন চালিত নৌকায় এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে সাদা পাথরের বিশাল এলাকা। স্থানীয় লোকজন এই সাদা পাথরের কারনেই এই এলাকাকে সাদা পাথর বলে থাকে। তাইতো এই এলাকার নাম ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। একসময় এ রাস্তা দিয়েই লোকজন যাতায়াত করতেন ভারতের তৎকালীন আসাম প্রদেশের রাজধানী শিলংয়ে। কালের পরিবর্তনে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে নামে রজ্জুপথ। দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারির অবস্থানও এ ভোলাগঞ্জ এলাকায়। পাথর কোয়ারি, রোপওয়ে আর পাহাড়ি মনোলোভা দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই পর্যটকদের ভ্রমণ করতে দেখা যায়।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ছবি
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ভ্রমণ গাইড – Bholaganj Sada Pathor Travel Guide
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যাওয়ার উপযুক্ত সময়
ভোলাগঞ্জ সব ঋতুতেই যাওয়া যায়। ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর নিয়ে স্ট্যাটাস এক এক জনের কাছে এক এক রকম তবে সব থেকে উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল ও তার পরবর্তী কিছু মাস। অর্থাৎ জুন থেকে ডিসেম্বর মাস। এই সময় পানিতে নদী পরিপূর্ণ থাকে। তবে বর্ষার পর পরই অন্যরকম সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায়। তখন পানি একটু কম থাকে ও নীল পানিতে অর্ধ ডুবন্ত পাথর গুলো দেখতে আরো আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য। ফুল বর্ষায় পাথর পানির নিচে ডুবে থাকে এটা ভোলাগঞ্জের আরেক সৌন্দর্য। তবে আমি মনে করি ভোলাগঞ্জ যাওয়ার উপযুক্ত সময় বর্ষার একটু আগে বা পরে যেতে।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর কিভাবে যাবোঃ
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যাওয়ার জন্য প্রথমেই আসতে হবে সিলেট শহর।
ঢাকা থেকে সিলেটঃ
বাসঃ রাজধানী ঢাকার ফকিরাপুল,গাবতলী, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সিলেট শহরে যেতে পারবেন সড়ক পথে। শ্যামলী, সৌদিয়া, এস আলম, হানিফ, গ্রিনলাইন ও এনা ইত্যাদি পরিবহনের বাস কিছুক্ষণ পর পর সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত বাস চলাচল করে। বাস ভেদে জনপ্রতি নন-এসির ভাড়া ৬৮০/- থেকে ৭০০/- টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১৪০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা।
ট্রেনঃ এছাড়া কমলাপুর কিংবা বিমান বন্দর রেলস্টেশন থেকে উপবন, পারাবত, জয়ন্তিকা অথবা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে করে সিলেট যেতে পারেন। জনপ্রতি শ্রেণিভেদে ভাড়া ৩২০/- থেকে ৬৫০/- টাকা।
বিমানঃ ঢাকা থেকে সিলেট আকাশ পথেও যেতে পারেন। প্রতিদিন সিলেটে বেশ কয়েকটি ফ্লাইট চলাচল করে। সময় লাগে প্রায় ৪৫ মিনিট। ভাড়া ৩০০০/- থেকে ৫০০০/- টাকা।
চট্টগ্রাম থেকে সিলেটঃ
বাস ও ট্রেনে করে সিলেট যেতে পারবেন। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেট যেতে উদয়ন এক্সপ্রেস এবং পাহাড়িকা নামের দুটি ট্রেন সপ্তাহের ৬ দিনই পেয়ে যাবেন।
সিএনজিঃ সিলেটের আম্বরখানা থেকে সিএনজি পাবেন, লোকাল সিএনজিতে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা জনপ্রতি ভাড়ায় ভোলাগঞ্জ যেতে পারবেন। ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায় সিএনজি রিজার্ভ করে যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে এক সিএনজিতে ৫ জন যেতে পারবেন।
বাসঃ মজুমদারী এলাকা থেকে বিআরটিসি, টুরিস্ট ও লোকাল বাস ভোলাগঞ্জের উদ্দেশ্যে প্রতি ২০ মিনিট পর পর সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এসব বাস চলাচল করে। ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন সাদাপাথর যেতে জনপ্রতি ৭০ টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন।
১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মত সময় লাগবে আম্বরখানা থেকে ভোলাগঞ্জ যেতে। ভোলাগঞ্জ নেমে ১০ নম্বর নৌকা ঘাট থেকে ৮০০ টাকায় সাদাপাথর যাওয়া ও আসা সহ নৌকা ভাড়া করতে পারবেন।
প্রতি নৌকায় সর্বোচ্চ ১০ জন যেতে পারবেন, যদিও কতৃপক্ষ ৮ জনের বেশি এক নৌকায় যেতে দিতে চায় না। এক্ষেত্রে বুঝিয়ে বললে সমস্যা হয় না। আপনি যদি একা বা কম মানুষ নিয়ে ঘুরতে যান তাহলে কম খরচে নৌকা ভাড়া করতে চাইলে অনেক নৌকা আছে যারা ১ জন ২ জন করে ৮-১০ জন মিলিয়ে নিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ভাড়া ভাগ করে দিলে নৌকা ভাড়ারে খরচ কমে যাবে। সাদাপাথর এলাকায় গিয়ে আপনাদের যতক্ষন ইচ্ছা সময় কাটাতে পারবেন। এক্ষেত্রে মাঝির সাথে কথা বলে মাঝির ফোন নাম্বার নিয়ে নিন।
কোথায় থাকবেনঃ
Bholaganj Sada Pathor থাকার জন্য তেমন কোন ভালো মানের আবাসিক হোটেল পাবেন না। আর পেলেও দরকার নাই ওখানে থাকার কারণ, Volaganj Sada Pathor দেখা শেষ করে চলে আসবেন সিলেট শহরে। কারণ সিলেট শহর থেকে অন্যান্য ভ্রমণ স্থানে যেতে সুবিধা হবে। কম খরচে থাকতে চাইলে এখানে ৫০০ – ১০০০ টাকার ভিতর হোটেল রয়েছে। তবে হোটেল নেয়ার সময় যে বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে, সেটা হচ্ছে যেখান থেকে সব দিকে মুভ করার যানবাহন পাওয়া যায়। তাই এই রকম জায়গা হিসাবে আমরা দরগা গেট হতে আম্বরখানা ও তালতলা, লামাবাজার বা কদমতলী এলাকা নির্বাচন করতে পারি।
আপনি যদি ভালমানের আবাসিক হোটেলে থাকতে চান তবে হোটেল হলি গেইট, পানসি ইন, হলি ইন, ব্রিটানিয়া হোটেল, লা ভিস্তা হোটেল, হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি হোটলে থাকতে পারবেন। এর জন্য খরচ পড়বে ২,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত। ৮,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকায় প্রতি রাতের জন্যে লাক্সারী হোটেল ও রিসোর্টের মধ্যে পাবেন হোটেল নূরজাহান গ্র্যান্ড, নিরভানা ইন, রোজ ভিউ হোটেল, গ্র্যান্ড প্যালেস, নাজিমগর রিসোর্ট সহ আরও বেশ কিছু হোটেল।
কোথায় খাবেনঃ
Bholaganj sada pathor এ কিছু খাবার হোটেল হয়েছে এখন। তবে তার সবগুলোই সাধারণ মানের। এখানে আপনি দুপুরের খাবার খেতে পারবেন। আর এখানে খেতে না চাইলে খাবার নিয়ে যেতে পারেন সিলেট শহর থেকে। সিলেটের জিন্দাবাজার এলাকায় বেশ কিছু ভালো মানের খাবারের জন্য রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
যেমন: পানশি, পাঁচ ভাই, পালকি।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ভ্রমণ খরচঃ
ঢাকা থেকে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ভ্রমণ খরচ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে কারন ভ্রমণ খরচ সবসময় আপনার নিজের উপর নির্ভর করবে। চলেন আলোচনা করা যাক সেটা কিভাবে। আপনি যদি এসি বাস, এসি ট্রেন বা প্রাইভেটকারে যান তবে খরচ একরকম আবার যদি বিমানে যান তাহলে আর এক রকম। যদি ননএসি বাস ও ট্রেনে যান তাহলে খরচ অনেক কম হবে। তবে আপনাদের একটা ধারণা দেওয়া যাক কিভাবে কত খরচ হতে পারে।
বাসঃ যাওয়া-আসা ১৪০০ টাকা, নরমাল হোটেল খরচ যদি রাত্রি যাপন করেন তবে এক রাতের জন্য খরচ হবে ১০০০ টাকা, খাবার খরচ যেমন খাবেন তেমন পড়বে তবে দুই দিন থাকলে ১০০০ টাকায় হয়ে যাবে। আর ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যাওয়া আসা খরচ ৭০০ টাকায় হয়ে যাবে, এটার মধ্যে বোট খরচও রয়েছে আপনাকে বোট এর জন্য কোন একটা গ্রুপে যোগ হতে হবে, যদি আপনি একা যান। তাহলে মোট খরচ হবে ৪১০০ টাকা এর আশেপাশে।
এসি বাসঃ যাওয়া-আসা ৩০০০ টাকা, মোটামুটি ভালো মানের হোটেল খরচ যদি রাত্রি যাপন করেন তবে এক রাতের জন্য খরচ হবে ৩৫০০ টাকা, খাবার খরচ যেমন খাবেন তেমন পড়বে তবে দুই দিন থাকলে ২০০০ টাকায় হয়ে যাবে। আর ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যাওয়া আসা খরচ ৭০০ টাকায় হয়ে যাবে, এটার মধ্যে বোট খরচও রয়েছে আপনাকে বোট এর জন্য কোন একটা গ্রুপে যোগ হতে হবে, যদি আপনি একা যান। তাহলে মোট খরচ হবে ৯২০০ টাকা এর আশেপাশে।
ট্রেনঃ যাওয়া-আসা ৭০০ টাকা, হোটেল খরচ যদি রাত্রি যাপন করেন তবে এক রাতের জন্য খরচ হবে ১০০০ টাকা, খাবার খরচ যেমন খাবেন তেমন পড়বে তবে দুই দিন থাকলে ১০০০ টাকায় হয়ে যাবে। আর ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যাওয়া আসা খরচ ৭০০ টাকায় হয়ে যাবে, এটার মধ্যে বোট খরচও রয়েছে তবে আপনাকে বোট এর জন্য কোন একটা গ্রুপে যোগ হতে হবে। যদি আপনি একা যান। তাহলে মোট খরচ হবে ৩৪০০ টাকা এর আশেপাশে।
বিমানঃ যাওয়া-আসা ৫৭০০ টাকা, ভালো মানের হোটেল খরচ যদি রাত্রি যাপন করেন তবে এক রাতের জন্য খরচ হবে ৫০০০ টাকা, খাবার খরচ যেমন খাবেন তেমন পড়বে তবে দুই দিন থাকলে ২০০০ টাকায় হয়ে যাবে। আর ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যাওয়া আসা খরচ ৭০০ টাকায় হয়ে যাবে, এটার মধ্যে বোট খরচও রয়েছে তবে আপনাকে বোট এর জন্য কোন একটা গ্রুপে যোগ হতে হবে। যদি আপনি একা যান। তাহলে মোট খরচ হবে ১৩,৪০০ টাকা এর আশেপাশে।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ভিডিও
আশেপাশের দর্শনীয় স্থানঃ
১। বিছনাকান্দি
২। জাফলং
৩। রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট
৪। লালা খাল
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পানিতে বা পাথরে নামার ক্ষেত্রে সতর্কতাঃ
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পানিতে নামার আগে অবশ্যই পানির স্রোত দেখে সর্তকতার সাথে নামতে হবে। যেকোন পাথুরে বিচ বা জাফলং ও সাদা পাথরের মত জায়গায় নামার সময় সর্তকতা অবলম্বন করে নামা উচিত। যারা সাঁতার জানেন না তারা অবশ্যয়ই লাইফ জ্যাকেট পরে নামবেন। পাথরের উপর দিয়ে হাটার সময় ধীরে সর্তকতার সাথে পা ফেলতে হবে, তা না হলে ঘটে যেতে পারে দূর্ঘটনা।