চারদিকে সবুজে ঘেরা একটি লেক ( Madhabpur Lake ) যার পানি আকাশের ছায়ায় হয়ে উঠে টলটলে স্বচ্ছ নীল। আর সেই স্বচ্ছ নীলের পানিতে ফুটে থাকে অজস্র নীল শাপলা এ যেন এক নীলাভ খেলায় মেতে উঠা লীলাভূমি। এ লেকটি কোন স্বপ্ন বা কল্পনার রাজ্যের কিংবা বিদেশের বুকেও নয়, লেকটি সবার কাছে মাধবপুর লেক নামে পরিচিত। মাধবপুর লেক মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। যা দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান। এই লেকের অবস্থান ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) মাধবপুর চা বাগানের ১১ নম্বর সেকশনে। এটিকে চা শ্রমিকরা ড্যাম বলে অভিহিত করেন।
মাধবপুর লেক – Madhabpur Lake
মাধবপুর লেকের নিজস্ব সৌন্দর্য রয়েছে যার কারণে আপনিও এর আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারবেন না। লেকটি অপূর্ব মায়া ছড়িয়ে রেখেছে, চারদিকের সুউচ্চ পাহাড়ের পরতে পরতে। লেকের টলটলে পানি, শাপলা শালুকের উপস্থিতি ও ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ আর জলজ পাখির কলতান পরিবেশটাকে যেন আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। এই লেকে ভেসে বেড়ায় নিজের ইচ্ছাখুশিতে বড় বড় কচ্ছপ আর মাছ আর ছায়াবৃক্ষের ডালে বসে ডাকছে পাখিরা। আপনি কি প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারাতে চান? তবে মাধবপুর লেকের এমন সৌন্দর্যে যে কেউই মুগ্ধ হয়ে মন হারিয়ে বসবে। প্রকৃতিপ্রেমীরা শান্তির খুঁজে চলে আসতে পারেন এই লেকে। সৌন্দর্য আর ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন নিঃস্বর্গের নিস্তব্ধতা।
হ্রদের দু-পাশের টিলাগুলোতে রয়েছে চায়ের গাছ যা হ্রদকে পাঁজর দিয়ে আগলে রেখেছে। এই লেক মূলত মাধবপুর চা-বাগানেরই অংশ। চা-গাছের ফাঁকে ফাঁকে যেমন রয়েছে চিরল পাতার ছায়াবৃক্ষ তেমনি রয়েছে হ্রদের তীর ঘেঁষে চেনা-অচেনা অনেক ঝোপঝাড়। আর হরকে রকম বুনো ফুল ফুটে রয়েছে এই ঝোপঝাড়ে। চা-গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য হ্রদের পাড় ঘেঁষে হাটার জন্য তৈরি করা হয়েছে সরু পথ। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হলে টিলার ওপর আছে তাঁবু সেখানেই একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। শীত মৌসুমে যেকোনো জায়গায় বসতে পারবেন কিন্তু বর্ষায় তাঁবু কিংবা সঙ্গের ছাতাটিই ভরসা।
টিলার ওপর দাঁড়িয়ে যেদিকেই চোখ যাবে দেখতে পাবেন বনের নীল রেখা। এই নীল রেখা অনেক দূরে গিয়ে যেন ছুঁয়েছে আকাশের সীমা। এই লেকে একসঙ্গে চা-বাগান, পানি, পাহাড় আর বুনো নির্জনতার আমেজ মেলে। প্রকৃতির এমন মেলবন্ধন আর কোথায় মেলে? ৫০ একর আয়তনের এই মাধবপুর লেকের দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিলোমিটার। সমতল চা বাগানের মধ্যে গাছের সারি এবং উঁচু উঁচু টিলার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই লেক। নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী দেখার পাশাপাশি আপনাকে মুগ্ধ করতে আরো রয়েছে পাহাড়ি পাখির গান আর নৃত্য। মাধবপুর লেককে দেখে মনে হবে এ যেন প্রকৃতির নিজ হাতে তৈরি কোন এক মায়াবী স্বর্গ।
লেকের প্রবেশপথটি পর্যটকদের জন্য পাকা ও আকর্ষণীয় করা হয়েছে। যাতে শীত মৌসুমে ঢল নামা দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক, শিক্ষার্থীসহ ভ্রমণপিপাসুরা হেঁটে লেকটি দেখতে পারেন এবং এই কারনেই সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে লেকের চারপাশে টিলার ওপর উঠার জন্য। আপনি একবার গেলে মনটা পড়ে থাকবে এখানে বার বার আসতে মন চাবে এই চা বাগানের লেকে। লেকের কাছ থেকে চা কিনতে চাইলে এখানে ন্যাশনাল টি কোম্পানির একটি চা বিক্রয় কেন্দ্রও রয়েছে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে মাধবপুর লেকের এবং মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে প্রায় ১২ কি.মি পূর্বে অবস্থিত। মাধবপুর লেক দেখতে যেতে হলে প্রথমে আসতে হবে শ্রীমঙ্গল। এরপর কমলগঞ্জের ভানুগাছ চৌমোহনা দিয়ে মাধবপুর লেক যেতে পারবেন ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস অথবা সিএনজি করে। এছাড়া মাধবপুর লেকে শ্রীমঙ্গল চা বাগানের কাছ থেকে সিএনজি ভাড়া নিয়েও যাওয়া যায়।
শ্রীমঙ্গল হয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে সিলেটের পথে হানিফ পরিবহন, টি আর ট্র্যাভেলস,সোহাগ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন ইত্যাদি বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলাচল করে। এসি/নন-এসি বাসের ভাড়া লাগবে ৫৭০-১২০০ আর ঢাকা থেকে সিলেট যেতে চাইলে রেলপথে রয়েছে পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালিনী এক্সপ্রেস কিংবা উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনে শ্রীমঙ্গল আসতে পারবেন। ট্রেনের টিকিটের মূল্য পরবে আসনভেদে ২৭৫-৬২৭ টাকা। এছাড়া আকাশপথে ভ্রমণ করতে চাইলে ঢাকা থেকে সিলেটে এসে তারপর সড়ক পথে শ্রীমঙ্গলে যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্য ভাল মানের হোটেল ও রিসোর্টের মধ্যে রয়েছে
১. গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ (পাঁচ তারকা),
২. রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট, টি টাউন রেস্ট হাউজ, টি রিসোর্ট (01749-014306)
৩. নিসর্গ ইকো রিসোর্ট, হোটেল প্লাজা ( 01766557780 )।
এই সকল হোটেল এবং রিসোর্টে বিভিন্ন সময় অনেক ডিসকাউন্ট থাকে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কথা বলে প্রয়োজনে ভাড়ার ক্ষেত্রে একটু দরদাম করে নিন। এছাড়া আপনি আরও কম খরচে শ্রীমঙ্গল থাকতে চাইলে একটু খুঁজে দেখলেই আপনার মন মত বিভিন্ন মানের হোটেল পেয়ে যাবেন শহরে।
কোথায় খাবেন
কিছু হালকা খাবার সাথে নিতে পারেন কারন মাধবপুর লেকের আশে পাশে খাবারের তেমন কোন ব্যবস্থা বা হোটেল নেই। এছাড়া শ্রীমঙ্গল শহরেই ফিরে খেতে পারেন। শ্রীমঙ্গলে নানান ধরণের রেস্তোরা আছে। যে হোটেলগুলোর মধ্যে পানশী ও পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এই রেস্টুরেন্টগুলোতে ১৩০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় ভর্তা ভাজিসহ নানা পদের খাবার খেতে পারবেন।
মৌলভীবাজার জেলার আরও কিছু দর্শনীয় স্থান
১. লাউয়াছড়া উদ্যান
২. হামহাম জল্প্রপাত
৩. চা বাগান
৪. মাধুবকুন্ড ঝর্ণা
৫. সাত রঙের চা – নীলকন্ঠ কেবিন
৬. বাংলাদেশ চা গবেষনা ইন্সটিটিউট
ভ্রমণের সময় যে বিষয়ে সতর্ক থাকবেন
১. জীব বৈচিত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না।
২. ভ্রমণের ক্ষেত্রে জোঁক ও সাপের থেকে সতর্ক থাকুন, শীতকালে এই সমস্যা কম থাকে।
৩. স্থানীয় লোকজনের সাথে বাজে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।